Sunderlal Bahuguna-Chipko
movement leader সুন্দরলাল বহুগুণা-চিপকো আন্দোলনের
ভূমিকাঃ- পৃথিবীর বুকে সময়ের সাথে সাথে এমন
বহু মানুষের আগমন ঘটেছে। যারা পরিবেশের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে
কাজ করে গেছেন। তাদের এই নিঃস্বার্থ কাজের পথে বহু বাধা বিপত্তি আসলেও, তারা কোনদিন
সেই বাধার কাছে মাথা নত করেননি। এমনও মানুষ আছে যারা সমাজের, পরিবেশের কল্যাণের জন্য
নিজের প্রান বলি দিতেও দ্বিধা করেননি। সেই রকম কল্যাণকারী মানুষদের মধ্যে
একজন হলেন সুন্দরলাল বহুগুণা। যিনি প্রাকৃতিক পরিবেশের কল্যাণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে
সবসময় কাজ করে গেছেন। ওনাকে নিয়েই আজকের আমাদের এই প্রতিবেদন। পরিচয়ঃ-
সুন্দরলাল বহুগুনা ১৯২৭ সালের জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখ মারদা গ্রামে জন্ম গ্রহন
করেন। যেটা তেহরিএর কাছে অবস্থিত উত্তরাখণ্ড রাজ্যে। তিনি ছিলেন একজন পরিবেশবিদ অর্থাৎ
তিনি ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক। তিনি পরিবেশকে খুব কাছ থেকে অনুভব করেছেন। তিনিই প্রথম
হিমালয় পর্বতের সবুজ বনকে রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ নেন চিপকো আন্দোলনের নামে ১৯৭০
সালে। তিনি তেহরি বাঁধের বিরোদ্ধেও আন্দোলন
শুরু করেছিলেন ১৯৮০ থেকে প্রায় ২০০০ পর্যন্ত। তিনি ভারতের পরিবেশবিদের মধ্যে একজন। পরবর্তী সময়ে তিনি এবং ওনার আন্দোলনকারী
সহযোগী দল পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য আরও বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যান। বিশেষ করে
বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে। প্রারম্ভিক জীবনঃ- ছুটোবেলা থেকেই তিনি
প্রকৃতিকে খুব ভালবাসতেন। ঐ সময় উঁচু জাত নিন্ম জাতের প্রচলন ছিল বেশি। আর উনি ছিলেন
নিন্ম জাতের। যার জন্য ছুটো বেলায় তাকে লড়াই করতে হয়েছিল অস্পৃশ্য নামক সামাজিক অভিশাপের
সাথে। তিনি ১৩ বছর বয়স থেকেই সামাজিক কাজকর্মে মনযোগ দেন। ওনাকে এই বিষয়ে সঠিক রাস্তা
দেখাতেণ শ্রী দেব সুমন। যিনি হলেন ঐ সময়ের অহিংস আন্দোলনের প্রচারককারী। তিনি গান্ধীজির
ডাকা অহিংসার পথ অনুসরন করতেন। ওনার স্ত্রীর নাম বিমলা বহুগনা। তিনি বিবাহ করেন একটা
শর্তে যে, বিবাহের পর তিনি সবসময় গ্রাম্য পরিবেশে আশ্রম বানিয়ে বসবাস করবেন। যা তিনি
গান্ধীজী থেকে অনুপ্রেনিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি হিলাময়ের পথে বহু পথ পায়ে
হেটে প্রাকৃতিক পরিবেশকে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং দেখতেন মানুষ কিভাবে পরিবেশের প্রতিনিয়িত
ক্ষতি করে যাচ্ছে। চিপকো আন্দোলন কি এবং কিভাবে শুরুঃ- চিপকো আন্দোলনের
নাম আমরা বহুবার শুনেছি। চিপকো একটি হিন্দি শব্দ, যার মানে হল চিপকিয়ে থাকা বা জরিয়ে
থাকা। সুন্দরলাল চিপকো আন্দোলন শুরু করেন ১৯৭০ সালের ২৬এ মার্চ থেকে উত্তরপ্রদেশে।
ওনার স্ত্রী প্রথম চিপকো আন্দোলনের ধারনা ওনাকে দেন। এই আন্দোলন শুরু করার মূল উদ্দেশ্য
ছিল বড় বড় ঠিকেদার বা উদ্দোগপতিদের হাত থেকে গাছ এবং বন জঙ্গলকে রক্ষা করা। ঠিকেদাররা
যখন গাছ কাটতে আসতেন তখন আন্দোলনকারীরা গাছকে গোল করে আলিঙ্গন করে রাখতেন। যাতে তারা
কোন গাছ না কাটতে পারে। ওনাদের স্লোগান ছিল ‘ইকোলজি ইস পার্মানেন্ট ইকোনমি’। তিনি হিমালয়ের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে
গিয়ে মানুষকে গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে জাগরণ করতেন। ফলে, আরও মানুষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ
করতে শুরু করে। প্রভাবঃ- প্রকৃতিকে বাচানোর জন্য তাদের এই পদক্ষেপ
দেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দীরা গান্ধীর সঙ্গে ওনার সাক্ষাৎকার হয়। তিনি ১৯৭০ সাল
থেকে প্রতিনিয়ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ায় সারা দেশে মানুষ ওনার সমর্থন করা শুরু করেন।
ফলে সবার নজরে আসা স্বাভাবিক। তাই ওনার সাথে প্রধানমন্ত্রী এর সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী
ঘোষণা করেন ১৯৮০ সাল থেকে আগামী ১৫ বছর পর্যন্ত সবুজ বনাঞ্চল কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
তেহরি বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলনঃ- সুন্দরলাল বহুগুনা এর জিবনের আরেকটি বড় অবদান হল তেহরি
বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন। চিপকো আন্দোলনের পরেই তিনি তেহরি বাঁধ প্রকল্পের
বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। যেহেতু তিনি গান্ধিবাদী ছিলেন তাই সত্যাগ্রহ আন্দোলনের
পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তিনি অনেকবার ভাগীরথী নদীর তিরে অনশনে যান। ১৯৯৫ সালে তিনি টানা
৭৪ দিনের অনশন করেন। সুপ্রিম কোর্টে এই বাঁধ নিয়ে অনেক বছর মামলা চলার পর ২০০১ সালে
এপ্রিলের ২৪ তারিখ ওনাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বাঁধ প্রকল্পের কাজ পূনরায় শুরু করা হয়।
২০০৪ সালে সেই বাঁধে জল জমা শুরু হয়। শেষ জীবনঃ- তেহরি বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলনের
শেষ করে তিনি কটি নামে একটি জায়গায় বসবাস শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পুনরায় উত্তরাখণ্ডের
রাজধানী দেরাদুনে চলে আসেন এবং স্ত্রীর সাথে বসবাস শুরু করেন। শেষ জীবনে সমাজের কল্যাণেও তিনি
অনেক কাজ করে গেছেন। হিমালয়ে বসবাসকারী গ্রাম্য মানুষদের জীবনধারার পরিবর্তনেও তিনি
অবিরাম কাজ করে গেছেন। আধুনিকতার ছুয়ায় বহু নদী যখন বিপদের মুখে পরে যায়, তাদেরকে বাচানোর জন্যও অবিরাম
কাজ করেছেন। পুরস্কার এবং স্বীকৃতিঃ- প্রাকৃতিক পরিবেশকে
বাঁচানোর জন্য ওনার এই প্রয়াসকে ভারত সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার পুরস্কার দ্বারা
অভিহিত করেছেন। ১৯৮১ সালে ভারত সরকার পদ্মশ্রী দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি তা নেননি।
১৯৮৯ সালে আই.আই.টি ররকি থেকে ওনাকে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। ২০০৯
সালে পরিবেশ সংরক্ষণকারী হিসাবে পদ্ম বিভোষন পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। সুন্দরলালকে
নিয়ে অনেক লেখক বইও লিখেছেন। উপসংহারঃ- ২০২১ সালের মে মাসের ২১ তারিখে
এই মহান আত্মা কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন ৯৪ বছর বয়সে। তবে ওনার
মারা যাবার পরেও তিনি বেঁচে থাকবেন লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে। ওনার এই কৃতি নতুন প্রজন্মকে
সবসময় অনুপ্রানিত করবে প্রকৃতির জন্য কিছু করার জন্য। কারণ, আমরা জানি যে বর্তমানের
এই ভুগবিলাসের উন্নত পৃথিবী যদি না থাকে তবুও মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু প্রকৃতি
ছাড়া মানুষ এক মুহূর্তও বাঁচতে পারবেনা। ওনার মৃত্যুর পর আমাদের এই দিকটাই
খেয়াল রাখতে লাগবে, যেন ওনার এই প্রয়াস কোন সময় বৃথা না যায়। ওনার দ্বারা সৃষ্ট এই
পদক্ষেপকে আমাদের মত নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ