Bengali essay on travelling
একটি ভ্রমন কাহিনী
ভূমিকাঃ-
ভ্রমন
করতে কার না ভাল লাগে। রোজকার এক ঘেয়ে জীবন থেকে একমাত্র ভ্রমনই আছে যা আমাদের স্বাধীন
নিঃশ্বাসের সুযোগ করে দেয়। বর্তমান যুগের এই ব্যস্ত জীবনযাপনে ভ্রমনই আছে যা মানুষকে
নতুন করে পুনরায় বেচে থাকার প্রেরনা জাগায়।
এই কারনেই আমি প্রত্যেক ৬ মাসে একবার
হলেও নতুন কোন জায়গায় ঘুরতে যায়। কারণ, বাঙালি হিসাবে একটা কথা খুব আছে যে বাঙালিরা
নাকি প্রচণ্ড ভ্রমন পিপাসো হয়। আর আমারও তাই মনে হয়। কারণ, আমারও ভ্রমন করতে প্রচণ্ড
ভাল লাগে। তাই এবারও একটা নতুন জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম।
এবার ফেব্রুয়ারি মাসে আমি এবং আমার
বন্ধুরা মিলে ত্রিপুরার জম্পুই পাহাড়ে যাবার পরিকল্পনা করি। এই জম্পুই পাহাড়ের সৌন্দর্য
অপরূপ। এই অভিজ্ঞতা নিয়েই আজকের আমাদের এই প্রতিবেদন।
ভ্রমনের গুরুত্বঃ-
বর্তমান যুগ হল বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের যুগে
প্রত্যেক মানুষই প্রচণ্ড ব্যস্ত। মানুষের চাহিদা প্রচণ্ডভাবে বাড়ছে। যার কারনে সবাই
নিজেরার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। যার কারনে দেখা
যায় আজকের দিনে বহু মানুষ একাতিত্তে ভোগে। ফলে এর থেকে জন্ম নেয় বিভিন্ন শারীরিক এবং
মানসিক রোগের। ভ্রমন এমন একপ্রকার ঔষধ, যেটা মানুষের মধ্যের সেই জড় আত্মাটাকে সতেজ
করে তুলে। বর্তমান যুগে মানুষ বাচে অতীতের
দুঃখ নিয়ে এবং ভবিষ্যতের চিন্তা নিয়ে। ভ্রমনই একমাত্র পথ যা মানুষকে সবসময় বর্তমানে
উপস্থিত রাখে। আর বর্তমানে থাকলেই একটা মানুষ সবচাইতে বেশি আনন্দ উপভোগ করতে পারে।
শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞদের
মতে একজন মানুষ যখন ভ্রমন করে এবং নতুন নতুন জিনিস উপভোগ করে এবং দেখে। তখন ঐ মানুষটির
মস্তিষ্কের কোষগুলি ভালভাবে সক্রিয় হয়। ফলে, মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বাড়ে। তাছাড়া বিভিন্ন
রোগের চিকিৎসায় আজকের দিনে বহু ডাক্তার ভ্রমনের পরামর্শ দেন।
আমরা ভ্রমন করি, জীবন থেকে
পালাতে নয়, বরং জীবন যাতে আমাদের থেকে পালিয়ে না যায় তার জন্য। তাই প্রত্যেক মানুষের
ভ্রমন করা খুবই প্রয়োজন।
স্থান নির্বাচনঃ-
ভ্রমনে
যাওয়ার আগে সঠিক স্থান নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা অনুযায়ী পরিকল্পনা করা।
সঠিক পরিকল্পনা না করলে সঠিক ভাবে ভ্রমনকে উপভোগ করা যায়না। ত আমরা ৪ বন্ধু একরাতে
বসে সব পরিকল্পনা করলাম এবং স্থান ঠিক করলাম।
ত্রিপুরার প্রায় সব দর্শনীয়
স্থান দেখার পর সবচাইতে আকর্ষণীয় স্থান বাকি ছিল জম্পুই পাহাড়। জম্পুই পাহাড় সম্পর্কে
অনেক পরেছি বইয়ে। কিন্তু কখনও যাওয়ার আর সুযোগ হয়নি। কিন্তু বইয়ে এবং মানুষের মুখে
এর সৌন্দর্যের কথা যখন আগে শুনতাম, তখন মনে মনে ভাবতাম যে একদিন নিশ্চয়ই যাব। শেষে
আমদের এই পরিকল্পনা সফল হল।
যাত্রাপথঃ-
আমরা যাত্রা শুরু করি আগরতলা থেকে। আগরতলা থেকে জম্পুই পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিমি। আমরা আগে থেকেই ঐখানের সরকারী লজ বুক করে রেখেছিলাম। তাই ঐখানে গিয়ে কোন প্রকার মাথা ঘামাঘামির দরকার নেই। ত আমরা যাত্রা শুরু করি প্রায় ৯ টায়। তারপর বড়মুড়া পাহাড় পেরিয়ে তেলিয়ামুড়াতে পৌঁছলাম। এরপর শুরু হয় আঠারমুড়া পাহাড়। আঠারমুড়া পাহাড়টা খুব সুন্দর। উপর থেকে নিচের দৃশ্যগুলি দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। আঠারমুড়া পেরিয়ে আমবাসা এবং তারপর মনু। মনুতে গিয়ে দুপুরের খাবারটা খেলাম। মনু থেকে একটি সহজ রাস্তা নিয়ে সোজা চলে গেলাম কাঞ্চনপুর। তখন প্রায় দুপোর ৩ টা বাজে। কাঞ্চনপুর থেকে জম্পুই আর বেশি দূরে নয়। প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে যায়।
লজে প্রথমদিনঃ-
পাহাড়ে উঠা মাত্র আমরা জম্পুই এর আসল সৌন্দর্য দেখতে পেলাম। ধীরে ধীরে যখন উপরে উঠছিলাম তখন বুঝতে পারলাম যা শুনেছি জাম্পুইএর নামে, জম্পুই তার থেকে অনেক বেশি সুন্দর। চারিদিকের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে আমরা লজে গিয়ে পৌঁছলাম। লজটা ছিল সরকারী, খুবই সুন্দর। লজের সামনের দিকে সম্পূর্ণ খুলা জায়গা দিয়ে খুব সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। লজে গিয়ে আর দেরি না করে স্নান সারলাম। কারণ, সারাদিন গাড়ি চরে শরীর একেবারে ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম। স্নান করে বিশ্রাম নিতে নিতে সন্ধ্যা। ত সন্ধার পরে আর লজ থেকে বের হলাম না। রাতে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম। ৯ টায় খেয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঃ-
সব সৌন্দর্য
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে হার মানে। আর তার আর একটি প্রমাণ পেলাম জম্পুই পাহাড়ে। শহরের
মানবসৃষ্ট সৌন্দর্য থেকে প্রকৃতির সৌন্দর্য কয়েকশো গুন বেশি। কোন তুলনাই হয়না। পাহাড়ে
গাড়ি দিয়ে যখন উঠছিলাম তখন নিচের সুন্দর দৃশ্যগুলি দেখে মন একেবারে উচ্ছাসিত হয়ে গেল।
তারই মাঝে হঠাৎ একটি ঝর্না দেখলাম রাস্তার পাশে। দেরি না করে আমরা নেমে পরলাম এবং সবাই
ঐ ঝর্নার জলে হাত, পা, মুখ ধুলাম। লজের কাছাকাছি যখন পৌঁছলাম তখন উপর থেকে বড়মুড়া পাহাড়ের
মত পাহাড়গুলিও ছুটো মনে হচ্ছিল।
আমরা আগে শুনেছিলাম
যে, জম্পুই পাহাড় থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত খুব সুন্দর দেখায়। তাই বিকালের পর আমরা
সবাই ছাদে গিয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করলাম। টকটকে লাল সেই সূর্যকে দেখতে কি সুন্দর
লাগছিল, সেটা বুঝানোর মত ভাষা আমার নেই। পরদিন সকালে আমরা সবাই ৫ টায় উঠে পরেছিলাম
সূর্যোদয় দেখার জন্য। উঠে চলে গেলাম ছাদে। ঐ দৃশ্যটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। এত মনোমুগ্ধকর
দৃশ্য এর আগে আমি কখনো দেখিনি।
লজ থেকে প্রায়
২৭ কিমি দূরে ছিল ত্রিপুরার সবচাইতে উঁচু স্থান বেতলিংশিব। যার উচ্চতা সমুদ্র থেকে
৯৩০ মিটার। ঐখান থেকে দৃশ্যটা ছিল অপরূপ। যা বলার মত ভাষা আমার নেই। একদিকে ছিল মিজোরাম
আর একদিকে ছিল ত্রিপুরা। না ভুলার মত সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ ছিল ঐ জায়গাটা।
জম্পুই পাহাড়ের আরেকটি
বিশেষ ফলের জন্য সুনাম আছে। সেটি হল কমলালেবু। কমলালেবু জম্পুই পাহাড়ে খুব ভাল উৎপাদন
হয়। তবে আমরা যে সময় গিয়েছিলাম ওইসময় কমলার ঋতুও চলে গেছে এবং ওদিকের মানুষ থেকেও জানতে
পারলাম যে এখন আর আগের মত কমলার চাষ হয়না। তাই কমলা আমাদের চোখে পরেনি। তবে এখন সুপারি
খুব ভাবে চাষ করা হয় জম্পুইএ।
স্থানীয় নিবাসে দ্বিতীয়দিনঃ-
প্রথমদিন লজে থাকার পর আমরা ভাবলাম দ্বিতীয়দিন স্থানীয়
কোন হোটেলে বা হোম স্টে তে থাকব। ত আমরা কাছাকাছি একটি হোম স্টে খুজে পাই। যেখান থেকেও
খুবই সন্দর দৃশ্য দেখা যায়। ঘরটি ছিল বাঁশ দিয়ে তৈরি টং ঘরের মত মাটি থেকে একটু উঁচুতে।
রুম গুলি ছিল খুবই সুন্দর এবং গুছালো। রুমের জানালা দিয়ে মিজোরামের দিকটা পুরুটা দেখা
যাচ্ছিল। রাতে আমরা ওদের তৈরি বিশেষ ডিস খেলাম। যা ছিল খুবই সুস্বাদু। খেয়ে দেয়ে তাদের
সাথে গল্পে বসলাম। তাদের স্থানীয় ভাষা আমাদের জানা ছিলনা। তাই হিন্দি ভাষায় আমরা গল্প
করলাম প্রায় রাত্রি ১২টা পর্যন্ত। তারপর পরেরদিন সকাল ৮টায় রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশে।
উপসংহারঃ-
আমাদের এই ২ দিনের জম্পুই এর
সফর শেষে যখন বাড়ি ফিরার সময় এল, তখন সত্যি মনটা মানতে চাইছিলনা সেই অপরূপ সৌন্দর্যকে
ফেলে আসার। কারণ, ত্রিপুরাতে আমরা এই প্রথম এমন কোন না ভুলার মত অভিজ্ঞতার সন্ধার পেয়েছিলাম।
তবুও, মনের মধ্যে প্রাকৃতির সেই মনোরম এবং অপরূপ সৌন্দর্যের স্ম্রতি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
প্রকৃতির সেই আশ্রয়ে ২ দিন কয়েক বছরের আনন্দের জোগান
দিয়ে গেল। তারই জন্য হয়ত আজও যখন ঘুমানের আগে চুখ বন্ধ করি তখন সেই অপরূপ সৌন্দর্য
চোখের সামনে ভেসে উঠে। যা পুনরায় ভ্রমন করার উচ্ছাস মনের মধ্যে জাগিয়ে যায় এবং বলে
যায় যে ভ্রমণই হল মানব জিবনের একমাত্র পথ যা আত্মাকে তৃপ্ত করতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ